ঝলমল তরণয আওয়ম লগ
আমরা তাকাই আমাদের এই উপমহাদেশের দিকে। ভারতের একটি পুরনো রাজনৈতিক দল হচ্ছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। স্বাধীনতার পর গত সাড়ে সাত দশকে ভারতের রাজনীতির ধরন বদলেছে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সংবিধানের সংশোধন করে ভারতকে সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। সেই সংবিধানের কোনো নাটকীয় পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। সমাজতান্ত্রিক দলগুলো জাতীয় রাজনীতিতে সেই অর্থে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। ধর্মরিপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। আর স্বাধীনতার পর থেকে যে দলটি দীর্ঘ সময় ভারতের শাসন ক্ষমতায় ছিল, সেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান আজ কোথায়? তরুণ নেতৃত্বও কংগ্রেসকে রাজনীতির মূলধারায় ফেরাতে পারছে না। নিতে পারছে গণমানুষের আস্থায়।
পাকিস্তানের অবস্থা তো আরও করুণ। ভারতের সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানে গণতন্ত্র আজ পর্যন্ত স্থায়ী রূপ নিতে পারেনি। যখনই কোনো রাজনৈতিক দল জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছে, তখনই সামরিক বাহিনী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সে বিবেচনায় বাংলাদেশ বরং গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে অনেক উজ্জ্বল। মানতে হবে, এ দেশেও সামরিকতন্ত্র দুইবার মাথাচাড়া দিয়েছে। গণতন্ত্রকে গৃহবন্দি করে রাজনীতিকে ঘরোয়া করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে রাজনীতির। বিজয়ী হয়েছে গণতন্ত্র। কারণ এ দেশে আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দল আছে। দলটি শুধু যে ঐতিহ্য ধারণ করে আছে, তা নয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত এই দলটি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। বাধা এসেছে, দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। সামরিক শাসকদের ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ তত্ত্ব প্রয়োগ করে রাজনীতিবিদ কেনাবেচা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার চেষ্টাও কম হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে রাজনীতি কারণ এদেশে আওয়ামী লীগের মতো একটি গণমুখী দল জনগণের মধ্যে সক্রিয়। আজ ২৩ জুন সেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যত আয়োজন
যে কথা সবার জানা, তবু আরেকবার বলতে হবে, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম ঢাকার রোজ গার্ডেন নামের বাড়িতে। শুরুতে দলটির নাম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রথম সভাপতি। পরে এই দলে যোগ দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রয়াত সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রথম যুগটি হচ্ছে ভাসানী যুগ। এই যুগের প্রথম দিকে দলটি ছিল সাম্প্রদায়িক। নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ। ভাসানী-মুজিব নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতার খোলস ত্যাগ করে, হয় অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ। কাগমারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। মওলানা ভাসানী একদল প্রগতিশীল নেতাসহ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন।
কাগমারীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভাসানী যুগের অবসান হয়। শুরু হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যুগ।... শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শুরু হয় আওয়ামী লীগের মুজিব নেতৃত্বের যুগ। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন এবং দলের নেতৃত্বও গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগে মুজিব যুগই হচ্ছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল যুগ। বাংলাদেশে শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন। তিনি ঘোষণা করেন পূর্ব পাকিস্তান নয়, এই ভূখণ্ডের নাম বাংলাদেশ। আমরা হাজার বছর ধরে বাঙালি। এখনো আমাদের পরিচয় হবে বাঙালি। ...বাংলাদেশে বড় ঢেউ তোলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ... বাঙালির যে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশে সেই ঐতিহ্য ধারণ করেন শেখ মুজিব এবং সেই জাতীয়তার বাহক হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ।’
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে নেয়া হয়। পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে প্রধান আসামি করা হয়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে তিনি কারামুক্ত হন। জনগণ তাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যা দেয়। সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। আইয়ুবের পর জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসেন এবং পাকিস্তানের উভয় অংশে একটি সাধারণ নির্বাচন দেন। আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়। সামরিক জান্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ডাকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। তাতে সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। তার নেতৃত্ব তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায়, ‘মুজিব যুগের আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।’ জাতীয় ও আন্তর্জাতীক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৫ সালে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
আরও পড়ুন: সংকট-ষড়যন্ত্রেও অদম্য আওয়ামী লীগ
মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হয় না। সেটা আরও বেশি করে প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগের বেলায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস আওয়ামী লীগের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে সব সময় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করা হলেও তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন বিদেশে ছিলেন, তারা বেঁচে যান। শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে এসে অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। শুরু হয় আওয়ামী লীগের হাসিনা যুগ। ভাসানী যুগ, সোহরাওয়ার্দী যুগ, মুজিব যুগ পেরিয়ে আজকের হাসিনা যুগে যে আওয়ামী লীগ এখন দেশ পরিচালনা করছে, সেই দলটি আজ আরও আধুনিক।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক হয়েছে। ২০১৯ সালে নির্বাচনের আগে যে দলটি ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের ঘোষণা করেছিল। সেই দলটি আজ স্মার্ট বাংলাদেশ রূপান্তরের স্বপ্ন দেখছে। এভাবেই আওয়ামী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা থেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা থেকে শোষিতের গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র ও সোনার বাংলা থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ অভিমুখে অভিযাত্রা। আওয়ামী লীগ রাজনীতির এই রূপান্তর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংগ্রামের মধ্যেই আওয়ামী লীগের জীবন এবং সংগ্রামের মধ্যেই তার এক যুগ থেকে আরেক যুগে উত্তরণ ও রূপান্তর।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭৪ বছর বয়সের প্রাচীন। দলটি এখন শক্তিশালী এবং তার নবপ্রজন্মের নেতৃত্বও শক্তিশালী। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আসতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। আদর্শবাদী, উদারনৈতিক এই রাজনৈতিক দলটির অস্তিত্ব বিনাশের চেষ্টাও হয়েছে। দলের ভেতরের কোন্দলও অনেক সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে। কিন্তু আলোর পথযাত্রী আওয়ামী লীগ সব বাধা-বিপত্তি মাড়িয়ে এগিয়ে গেছে। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারিশমা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। তিনি এখন বিশ্বনেতা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে অভিনন্দন। জনগণের দল আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য, জনগণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। দলটির প্রতি জনগণের আস্থা আছে। সেই জন-আস্থার প্রতিদান হিসেবে জন-আকাক্সক্ষা পূরণে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিক আওয়ামী লীগ। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমুন্নত রাখুক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জয়তু আওয়ামী লীগ। জয় শেখ হাসিনা।
]]>from somoynews.tv | RSS Feed https://ift.tt/YtCRN0x
via IFTTT
Comments
Post a Comment